বুধবার, ৩ নভেম্বর, ২০১০

গল্পঃ কিছু সুন্দর স্বপ্নের অপমৃত্যু


-এই সীমা এই, আরে এইদিকে আয়।
-এইতো আসছি আপু।
-কি ব্যাপার? কতক্ষণ ধরে দাঁড়াইয়া আছি, তোর কোন খবর নাই। আজকে এত দেরি হল কেন?
-আর বোল না আপু, স্কুল থেকে ঠিক করছে পিকনিকে যাবে। তো সেটার জন্য জায়গা ঠিক করা নিয়ে সবাই মিলে আলোচনা করতেছিল। এই কারনে একটু দেরি হয়ে গেল। তুমি রাগ কর নাই তো আপু?
একবারে অনেক কথা বলে ভয়ে ভয়ে আপুর দিকে তাকাল।
-রাগ আর কি করব? কিন্তু কথা হল, এখন পিকনিকে যে যাবি টাকা পাবি কই? আম্মুর কাছে তো মনে হয় এখন টাকা পাওয়া যাবে না।
-ওইটা নিয়ে চিন্তা কর না আপু, আমার কাছে কিছু জমানো টাকা আছে।
-তুই আবার টাকা পাইলি কই?
-এই মাঝে মাঝে পাওয়া টাকা গুলা জমাই রাখছিলাম। এতদিনে বেশ কিছু টাকা হয়ে যাওয়ার কথা।
-ঠিক আছে, দেখা যাক। লাগলে আমাকে বলিস, দেখি ব্যবস্থা করতে পারি নাকি।
-না না আপু, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমার কাছে যা আছে তা দিয়ে হয়ে যাবে।

রীমার কাছ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। কেন যে সৃষ্টিকর্তা ওদেরকে বিত্তবান করে পাঠাল না, অন্তত বাবা বেঁচে থাকলেও এতটা কষ্ট করতে হত না। ছোট বোনটা অনেক আহ্লাদি, ঘোরাঘুরি করার অনেক শখ। কিন্তু টাকার অভাবে সব সময় যেতে পারে না। ওর কষ্ট গুলার কথা কাউকে বলেও না, নিজের ভিতরেই সব কিছু জমিয়ে রাখে। মেয়েটার জন্য কষ্ট হয়, কিন্তু করার কিছুই নেই। তার নিজের পড়াশোনার পেছনেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এখনো কলেজ শেষ করতে পারল না। তার উপর ডাক্তার হওয়ার খুব শখ, কিন্তু কতটুকু পূরণ করতে পারবে সেটা জানা নাই, যদিও ছাত্রী হিসেবে সে খারাপ না। তারপরও ডাক্তারি পড়তে খরচ অনেক।

রীমা মনে মনে ভাবে, যা কিছুই হোক। একদিন ঠিকই ডাক্তার হবে সে। তারপর ছোট বোনটাকে নিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করবে। মনে মনে খানিকটা আনন্দ পায় সে। একদিন সুখ নিশ্চয় দেখা দিবে।

হঠাৎ করে তীক্ষ্ণ শিষের শব্দে রীমার ঘোর ভাঙ্গে। তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে বিচ্ছিরি ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ওই ছেলেটা আবারো বিরক্ত করতে এসেছে। ভাবতেই সীমার মুখের দিকে চেয়ে দেখে বেচারী ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
-আপু, ওই মাস্তানটা আবারো এসেছে। এখন কি হবে?
-চিন্তা করিস না, দেখি কি করা যায়।

রীমা ছেলেটার দিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটা ধরল। তাড়াতাড়ি করে হেঁটে আসার সময় কিছু অশালীন শব্দ শুনতে পেল। ছেলেগুলা নিজেদের মধ্যে ওকে নিয়ে অশালীন কথা বলছে আর অট্টহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আশেপাশের লোকজনও ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে রীমার মরে যেতে ইচ্ছা করল। কোনমতে ঢোঁক গিলে ছোট বোনের দিকে তাকাল।
-কান বন্ধ করে তাড়াতাড়ি হাঁট।

সীমার বয়স এখনো খুব কম। মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওদের কথাগুলো পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও খারাপ কথা বলতেছে এটা ঠিকই বুঝতে পারল। ভয়ে তাড়াতাড়ি করে আপুকে অনুসরণ করা শুরু করল।
-আপু, আশেপাশের লোকজন ওদেরকে মার দিতে পারে না? কেউ কিছু করতেছে না।
-ওদের ক্ষমতা অনেক। ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেই মরতে হবে।
-তাই বলে এভাবে প্রতদিন অপমান হজম করে যেতে হবে?
রীমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল
-শোন আম্মুকে এই ব্যাপারে কিছু বলবি না। আম্মু এমনিতেই অনেক টেনশনে থাকে, তার উপর এই কথা শুনলে আরো টেনশন করা শুরু করবে।
-ঠিক আছে আপু, বলব না।



রেহানা বেগমের স্কুল আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফিরে রান্নাবান্নার পাট চুকিয়ে উলের কাঁটা নিয়ে বসলেন। সামনে শীত আসছে, এর আগেই দুই মেয়ের জন্য দুইটা উলের সোয়েটার তৈরি করে ফেলার ইচ্ছা। মেয়েরা আসতে আরো ঘন্টা দুয়েক বাকি আছে। তারপর আবার কিছু ছাত্র ছাত্রী পড়তে আসবে। এরপর আর সময় পাওয়া যাবে না। এই ছাত্র ছাত্রী পড়িয়ে আর স্কুলের বেতন দিয়েই কোনমতে সংসারটা চালাতে হয়।

রেহানা বেগমের হঠাৎ মৃত স্বামীর কথা মনে পড়ে যায়। তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত এত কষ্ট করতে হত না। স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবনটা পার করে দিতে পারতেন। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন মেয়ে দুইটাই তার সব। এদেরকে পড়াশুনা করিয়ে ঠিকমত মানুষ করতে পারলেই তার শান্তি। রেহানা বেগম মনে মনে কিছু সুখের দিনের ছবি আঁকতে শুরু করলেন।



-কিরে তোদের স্কুল থেকে নাকি পিকনিকে যাবে?
রাতের বেলা সীমাকে পড়াতে বসিয়ে রেহানা বেগম জিজ্ঞেস করলেন।
সীমা কিছুটা ভয়ে ভয়ে বলল,
-হ্যাঁ আম্মু।
-তো আগে বলিস নাই কেন? এখন যাবি যে টাকা পাবি কই?
-টাকা আমি জোগাড় করে রেখেছি আম্মু।
-তোর টাকা গুলো খরচ করে ফেলবি?
রেহানা বেগম কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেন।
-রেখে দে তোর টাকাগুলো, পরে কাজে লাগতে পারে। আমি দেখি জোগাড় করতে পারি নাকি। কবে যাবি?
-দিনটা এখনো ঠিক হয় নাই। শুধু জায়গা ঠিক হয়েছে। সীতাকুন্ডের ইকোপার্কে যাব। খরচ মনে হয় ৪০০ টাকার মত লাগবে।
-ঠিক আছে দেখি। এখন পড়তে বয়।

-আম্মু একটু শুনবে?
সীমা কিছুটা ইতস্তত করতে থাকে।
-আবার কি হয়েছে?
রীমার নিষেধ স্বত্বে ও সীমা রেহানা বেগমকে বিকালের ঘটনা সব বলে দিল।
-ওই গুন্ডা ছেলেটা আজকেও আপুকে বিরক্ত করেছে।
রেহানা বেগম একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
-কি? আবার বিরক্ত করেছে? আগে বলিস নাই কেন?
-আপু নিষেধ করছিল।
-রীমা নিষেধ করেছে?
রেহানা বেগমকে একটু চিন্তিত দেখাল।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আর কিছু হলে আমাকে জানিয়ে দিবি।

রেহানা বেগম খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই ছেলে গুলার জ্বালায় আর পারা গেল না। কয়েকদিন ধরেই ঝামেলা করতেছে। এদের মায়েরা কি জানে না, ছেলে কি করতেছে? রেহানা বেগম কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন।

এবার কিছু একটা করতেই হবে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না।

পরক্ষণেই মনে হল, এদের বিরুদ্ধে তিনি কি করতে পারবেন?
এদের শক্তি যে অনেক বেশি। একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।



কিছুদিন পর সীমা খুব খুশি খুশি ভাব নিয়ে স্কুল থেকে বের হল। বের হয়েই রীমাকে দেখতে পেল, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
-আপু, কালকেই আমরা পিকনিকে যাচ্ছি। সব কিছু কনফার্ম।
-কালকেই? কয়টায় রওনা দিবি?
-সকাল আটটার মধ্যে সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
-ভাল, অনেক মজা করতে পারবি।
-হ্যাঁ আপু। ইশশ তোমাকে যদি নিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে আরো মজা করতে পারতাম।
-আমি তোদের সাথে গিয়ে কি করব? এমনিতেই অনেক মজা হবে।
-তারপরও আপু, তুমিই তো আমার সবচেয়ে প্রিয়।
-থাক, বুঝতে পারছি...

হঠাৎ শিষের শব্দে কথাবার্তায় ছেদ পড়ল। উফ আবার ছেলেটা বিরক্ত করতে এসেছে। রীমা কোন দিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করল।
-এই রীমা, এই কথা শুনে যাও।
রীমা আরো তাড়াতাড়ি পা চালতে শুরু করল।
হঠাৎ ছেলেটা তার হাত ধরে টান দিল।
-কি হল, ডাকছি যে শুনতে পাচ্ছ না?
রীমা ঝটকা মেরে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ছাড়াতে পারল না।
-হাত ছাড়েন।
-ছাড়ার জন্য ধরছি নাকি?
-আপনার সমস্যাটা কি? কি চান আপনি?
-কি চাই তুমি বুঝ না? আমি শুধু তোমাকে চাই
-হাত ছাড়েন বলতেছি, নাইলে চিৎকার করে লোকজন জড় করব।
বলেই আশে পাশে তাকিয়ে দেখল অনেকেই তাদের দিকে তাকিয়ে মজা দেখছে।
ছেলেটা এবার হা হা করে হেসে উঠল।
-লোকজন ডাকবে? ডাক না, দেখি তাদের কত সাহস।
রীমা এবার জোর করে ঝটকা দিয়ে হাতটা কোনমতে ছাড়িয়ে দৌড় লাগাল। পিছন থেকে অশালীন ভাষায় ছেলেগুলা তাকে ডাকতে লাগল।

রীমা কান্না করতে করতে ঘরে ঢুকে দেখে রেহানা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল। রেহানা বেগম খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
-কি হয়েছে? এই রীমা কি হয়েছে?
রীমার মুখে কোন ভাষা নেই। সীমা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,
-ওরা আপুর হাত ধরে টান দিয়েছে, আরো অনেক আজে বাজে কথা বলেছে।

রেহানা বেগমের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ছেলে গুলার সাহস এত বেড়ে গেছে? এখনই একটা বিহিত করা দরকার। ভাবতেই ঘরের শাড়িটা পড়া অবস্থায় বাইরে বেড়িয়ে গেলেন। পিছন থেকে রীমা মাকে থামাতে চেষ্টা করল, কিন্তু রেহানা বেগম আগেই বের হয়ে গেলেন।

এক প্রতিবেশীকে নিয়ে রেহানা বেগম ছেলে গুলার কাছে গেলেন। তাকে দেখেই ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো।
-স্লামালাইকুম ম্যাডাম। ভাল আছেন?
-তোমাদের সমস্যাটা কি? আমার মেয়েকে বিরক্ত কর কেন?
-কই ম্যাডাম বিরক্ত তো করি না। মাঝে মাঝে একটু খোঁজখবর নেই আর কি।
বলেই সবাই মিলে হাসতে শুরু করল।
রেহানা বেগমের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সামনের ছেলেটাকে একটা চড় কষিয়ে দিলেন।
-আদব লেহাজ কোনদিন শিখ নাই? এই শিখাইছে তোমাদের বাবা মা?
ছেলেগুলা এইবার হাসি বন্ধ করে দিল।
-দেখেন ম্যাডাম কাজটা ভাল হয় নাই। আমরা কি করতে পারি তা আপনার জানা নাই।
-কি করবা তোমরা? আমি এখনই পুলিশের কাছে যাব।
-কাজটা কিন্তু ভাল হচ্ছে না বলে দিচ্ছি।
রেহানা বেগম কোন দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলেন।

হঠাৎ পিছন থেকে ছেলেটা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তারপরই ছুরি দিয়ে পেটের মধ্যে একটা কোপ দিয়ে ছুটে পালাল। লোকজন কিছু বুঝে উঠার আগেই সব কিছু খুব দ্রুত ঘটে গেল।

রেহানা বেগম মাটিতে শুয়ে কাতরাতে লাগলেন। এতক্ষণে লোকজনের সম্বিত ফিরে এল। সবাই মিলে ধরাধরি করে রেহানা বেগমকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু তার আগেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।



কান্না করতে করতে রীমা মায়ের কথা চিন্তা করতে লাগল। আজ তার জন্যই এত সমস্যা, সে না থাকলে এত কিছু ঘটত না। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

হঠাৎ হৈ চৈ এর শব্দে ঘুমে ভেঙ্গে যায়।
-এই সীমা, কি হয়েছে রে?
এক ছুটে বাইরে এসে দেখে অনেক গুলো লোকজন একটা কফিন সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রীমা কিছুই বুঝতে পারে না, একসময় সীমাও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। দু জনই হতবাক।

একজন লোক নীরব ভঙ্গিতে কফিনের ডালা খুলে দিলে দুই বোন আঁৎকে উঠে। কফিনের ভেতরে শুয়ে থাকা মানুষটা দেখতে অবিকল তাদের মায়ের মত। কিছু বুঝে উঠার আগেই সীমা দেখতে পেল তার বোন টলতে টলতে পড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বোনকে ধরে ফেলল। সীমা বুঝতে পারল তাদের মা আর নেই। তখন পড়ে যাওয়া বোনকে জড়িয়ে ধরে নীরবে চোখের জল ফেলতে শুরু করল। বুঝতে পারল তাদের দুই বোনের মাথার উপর থেকে সবচেয়ে বড় ছায়াটা আজ সরে গেছে। তাদের ভবিষ্যতের সব আলো নিভে গেছে। চারদিকে এখন শুধুই অন্ধকার।



এরপর অনেক কিছু ঘটে যায়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা অনেক মানব বন্ধন করে। অনেক পত্রিকায় খবর ছাপা হয়। একসময় কতৃপক্ষের টনক নড়লে দোষী ছেলেরা গ্রেপ্তার হয়, তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। সবাই ভাবতে থাকে অনেক ভাল ভাবে সব কিছু শেষ হয়ে গেল। একসময় মেয়েগুলোর কথা সবাই ভুলে যায়। তাদের কি অবস্থা কেউ জানার চেষ্টা করে না, কেউ তাদের খোঁজ নিতে যায় না।



রীমা, সীমার অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতে থাকে। যে মেয়েটা একসময় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখত, আজ সে সব কিছু হারিয়ে বোনটাকে মানুষ করার যুদ্ধে নেমেছে। তার নিজের স্বপ্নটা বোনকে দিয়ে পূরণ করাতে চায়।



সীমা ক্লাস সেভেনে উঠে গেছে। মা মারা যাওয়ার পর তাদেরকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। রীমা লেখাপড়া ছেড়ে কি একটা কাজে যোগ দিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে সীমার পড়াশুনা চলে। প্রতি রাতে রীমা কাজে বের হয়। কিন্তু সীমা জানে না কি এমন কাজ আছে যেটা রাতে করতে হয়। রীমাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে একটা অফিসে নাইট শিফটে কাজ করে। সীমা আর কথা বাড়ায় না। রাতে একা একাই থাকে, আর মন দিয়ে পড়াশুনা করার চেষ্টা করে।



-টাকা এত কম দিলেন কেন? আমার রেট আপনি জানেন না?
-চুপ থাক। দুই টাকার মাগী আবার বড় বড় কথা কয়। যা দিছি এইটাই অনেক বেশি।
রীমাকে বিছানায় ফেলে লোকটা হনহন করে বেরিয়ে যায়।

রীমা বিছানায় শুয়ে নীরবে কাঁদতে থাকে। প্রতি রাতেই এভাবে একবার করে কাঁদে। অনেক বড় স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু ছোট বোনটার মুখের দিকে চেয়ে সব কিছু ছেড়ে আজ তাকে এই পথে নামতে হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না, অনেক চেষ্টা করেছে সে, একটা কাজ জোটানোর জন্য হন্য হয়ে পথে পথে ঘুরেছে। কিন্তু সব জায়গায়ই কিছু হিংস্র পশুর উন্মত্ত লালসার শিকার হতে হয়েছে। শেষে বাধ্য হয়ে এসব ঘৃণ্য পশুদের সামনেই নিজেকে সঁপে দিতে হয়েছে। এখন প্রতি রাতে তার দেহের প্রতিটা কোনা হাতড়িয়ে পশু গুলা শরীরে উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে

রীমা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। এভাবে কতদিন পার করতে হবে সে জানে না। এই জীবন তো সে চায় নি। সবসময় সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখত, কিন্তু আজ?

বোনটাকে নিয়েও তার অনেক দুশ্চিন্তা। মেয়েটাও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। তার মতই সুন্দরী হয়ে উঠছে। মানুষরূপী এইসব পশুদের ছোবল একসময় তার উপরও পড়বে। বোনটাকে তাই সব সময় আগলে রাখতে হয়। কিন্তু কতদিন ধরে রাখতে পারবে তা জানা নেই। ভবিষ্যতের জন্য এখন আর কোন সুখ স্বপ্ন জমা করা নাই। ভাবতে গেলেই সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখতে পায়, কোথাও আলোর ছিটেফোঁটাও নাই।

শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১০

নিঃসঙ্গ এক যুবকের গল্প

প্রচন্ড ভয়ে ছুটে চলছি। পেছন থেকে তাড়া করছে ভয়ালদর্শন এক মহিষ। মহিষ টার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। প্রচন্ড ক্ষেপে আছে মহিষটি কোন কারনে। ছুটছি তো ছুটছিই। কোন দিকে খেয়াল নেই। ছুটতে ছুটতে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তারপরও বিরামহীন ভাবে ছুটে চলতে হচ্ছে। হঠাৎ কিছু একটার সাথে পা আটকে গিয়ে পড়ে গেলাম। আসন্ন বিপদ টের পেয়ে সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগল। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিনা। মহিষ টাও একই রকম ভাবে ছুটে আসছে। আর একটু পর কি হবে সেটা কল্পনাও করতে পারছিনা। এমন সময় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে চপ চপ করছে। আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠছে। তিক্ত একটা অনুভূতিতে মনটা বিষিয়ে উঠল। উঠে মোবাইলে দেখলাম রাত ৩ টা ৩৬ বাজে। এখনও সকাল হতে অনেক সময় বাকি আছে। আস্তে আস্তে মশারী থেকে পা বের করে বিছানা থেকে নামলাম। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে জগ থেকে কিছু পানি গলায় ঢাললাম। তারপর রুমে ফিরে এসে আবার শুতে গেলাম। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর বুঝতে পারলাম আর ঘুম আসবে না। আবার উঠে পড়লাম। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুঃস্বপ্নের রেশটা আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগল। গতকালকের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। সারা দিনে কিছুই করতে পারি নি। গত কয়েকটা দিন ধরেই তো কিছু করতে পারছি না। সারাদিন একা একা বসে থাকা আর ভাবনার মধ্যে ডুবে যাওয়া ছাড়া। এভাবে একজন মানুষ বাঁচতে পারে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম। কোন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ নাই, শুধু ভার্সিটিতে দেখা হওয়া ছাড়া। তাও ঠিকমত ক্লাস করি না। একা একটা সিটে বসে স্যারদের বোরিং লেকচার শোনা যে কতটা বিরক্তিকর আর যন্ত্রণাদায়ক সেটা আমার চেয়ে ভাল করে আর কেউ বুঝতে পারবেনা। তবুও কিছু করার নাই। এত কাজের ভিড়ে একমাত্র আমারই কোন কাজ নাই। কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। এমন সময় ফজরের আজান শোনা যায়। আজানের ধ্বনিটা এই মুহূর্তে খুব মধুর মনে হয়। আস্তে আস্তে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করে। কাছাকাছি কোথাও কিছু কাক ডেকে উঠে। কাকের কর্কশ ধ্বনি ও এই সময় খুব ভাল লেগে উঠে। আস্তে আস্তে মনটা পবিত্র হয়ে হয়ে উঠল। মিষ্টি একটা বাতাস মাঝে মাঝে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। ভোরের এই অপার্থিব সৌন্দর্যে মনটা ভরে উঠল। এইসময় শীলার কথা মনে পড়ল। ইদানীং আমার সব ভাল মুহূর্তগুলোতে ই তার উপস্থিতি টের পাচ্ছি। ইচ্ছে করছে তার সাথে কথা বলতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। কারন শীলার কোন নাম্বার আমার কাছে নাই।

শীলা আমাদের ভার্সিটির কাছেই একটা কলেজে পড়ে। একদিন ওর কলেজের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একনজর দেখেছিলাম। তাকে দেখতে পাওয়ার মুহূর্তটা স্পষ্ট মনে আছে। কয়েকজন মেয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন অপূর্ব সুন্দরী কিছুটা সময়ের জন্য আমাকে স্থবির করে দিয়েছিল। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন একসাথে ঢেলে তাকে তৈরী করা হয়েছে। পাশের বান্ধবীদের কথা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম ওর নাম শীলা। ওকে সেদিন একনজর দেখার পর থেকেই অসম্ভব ভাল লেগে গিয়েছিল। ওর চোখ, মুখের অবয়ব, কথা বলার ভঙ্গী সব কিছুই আমাকে আশ্চর্য রকম ভাবে আকর্ষিত করছিল। এটাকেই বোধহয় প্রেম বলে। এতদিন ধরে যে ছেলেটা প্রেম করবে না বলে পণ করে এসেছে, আজ হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখার পর থেকে তার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। প্রেম যে কিভাবে নিজের অজান্তে চলে আসে, চিন্তা করে ভেবে পাই না। আস্তে আস্তে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলাম। কল্পনায় শীলার সাথে কথা বলা শুরু করলাম।

একসময় হঠাৎ করে মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম ৭ টা বেজে গিয়েছে। একটু পরেই ভার্সিটি যেতে হবে। ধ্যান ভেঙ্গে ছুটে গিয়ে মা কে ওঠালাম নাস্তা দেবার জন্য। তারপর প্রাতঃক্রিয়া ও নাস্তা সেড়ে দ্রুত ভার্সিটির পথে রওনা হলাম। প্রতিদিনের মত আজকেও পিছনের বেঞ্চে বসে ক্লাসের ছেলে মেয়েদের কথাবার্তা আচরণ লক্ষ্য করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার এলেন। যথারীতি বোরিং লেকচার শুরু হল। স্যারকে খুব বিরক্তিকর লাগতে শুরু করল। হঠাৎ স্যারের চোখ দুটো রাতে স্বপ্নে দেখা মহিষ টার লাল চোখের মত মনে হতে লাগল। লেকচার তোলার বদলে খাতায় মহিষ টার আদলে স্যারের ছবি আঁকতে শুরু করলাম। একেবারে তন্ময় হয়ে ছবি আঁকছিলাম। হঠাৎ চোখ তুলে দেখলাম স্যার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি করে খাতা লুকাতে গেলাম, কিন্তু ততক্ষণে স্যার দেখে ফেললেন কি করছি। স্যার খুব ক্ষেপে গিয়ে আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ঠিক করলাম আজকে আর কোন ক্লাসই করব না। কি করা যায় ভাবতে লাগলাম।

তখন মনে হল শীলা কে দেখতে যাওয়া যায়। পাশেই ওর কলেজ। তাই চিন্তা করে রওনা দিলাম শীলার কলেজের দিকে। পথে পিচ্চি একটা মেয়ে হাতে ফুল নিয়ে বলল, “স্যার একটা ফুল নিয়া যান, ক্ষিদা লাগছে, কিছু খামু”। অন্য সময় হলে হয়ত এড়িয়ে যেতাম কিন্তু তখন কি ভেবে যেন মেয়েটার হাত থেকে একটা ফুল নিয়ে তাকে ১০ টাকা ধরিয়ে দিলাম। মনের অজান্তে ঠোঁটের এককোণে লাজুক একটা হাসি ফুটে উঠল। ফুলটা নিয়ে আবার রওনা দিলাম। কলেজের ক্যাম্পাসে এসে দেখি অনেক মানুষ। তখন লজ্জা পেয়ে ফুলটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। আজকে শীলা দের কলেজে অনেক ভীড়, কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে মনে হল। গেটের পাশে গিয়ে এককোণে বসে পড়লাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন শীলা এই দিক দিয়ে যাবে। কিন্তু অনেকটা সময় বসে থাকার পরও তার কোন দেখা নেই। এই পর্যন্ত চারদিন এখানে এসেছি, কিন্তু সেই প্রথমবারের পরে আর একবারও তার দেখা পাই নি। আজ জেদ চেপে গেল। ঠিক করলাম আজকে না দেখে যাব না। আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম কযেকজন মেয়ে শাড়ি পড়ে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। খেয়াল করলাম তাদের মধ্যে শীলা ও আছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে হয়ত আজ শাড়ি পড়ে এসেছে। আমার দেখা সেই শীলার সাথে মিল খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে গেল। কি অদ্ভূত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। শাড়ি পড়াতে রূপ যেন কয়েকশ গুন বেড়ে গেছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগলাম। কল্পনায় দেখতে পেলাম সে মিষ্টি হাসি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু পরক্ষণেই বাস্তব জগতে ফিরে এসে দেখলাম শীলা আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে গেটের ভেতর ঢুকে চলে গেল। আমি হতাশাগ্রস্থ হয়ে আবার বসে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম, কিভাবে তার সাথে একবার কথা বলা যায়। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একসময় কিছু ভেবে না পেয়ে উঠে বাসার দিকে হাঁটা ধরলাম। মাথার ভেতরটা দপদপ করা শুরু করল। বারবার রাতে স্বপ্নে দেখা মহিষ টার লাল চোখ দুটো ভেসে উঠতে লাগল। দুঃস্বপ্নটা যেন আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। ঠিক করলাম এখন আর বাসায় ফিরব না। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম লেকের পাড়ে।

লেকের পাড়ে বসে পানির ছোট ছোট ঢেউ দেখতে লাগলাম। মনের ভেতর চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। এভাবে আর কতদিন চলবে? নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই ভেবে পেলাম না। লেকের পাড়ের স্নিগ্ধতার কারনে একসময় মাথার যন্ত্রণাটা কিছুটা কমে আসল। আস্তে আস্তে উঠে বাসার পথে রওনা দিলাম।

বাসায় পৌঁছে খাওয়া দাওয়া সেরে একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খুব চমৎকার একটা বই, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর ‘মিস্টার মিসন’স উইল’। বইটা পড়তে গিয়ে ইউস্টেসের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারলাম না। যখনই অগাস্টার কথা আসছে তখনই শীলার কথা ভেবে মাথার ভেতর যন্ত্রণা করতে শুরু করল। একসময় বইটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। একপাশ হয়ে শোয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বারবার শীলার চেহারা ভেসে উঠছে। সেই সাথে প্রকাণ্ড দুইটা লাল চোখ মাঝে মাঝে শীলা কে কল্পনা থেকে সরিয়ে দিতে লাগল। মনে হতে লাগল চোখ দুটো শীলা কে কোন এক কারনে আমার কাছে আসতে দিতে চাইছে না। মাথার যন্ত্রণাটা আবার বাড়তে শুরু করল। হঠাৎ খেয়াল করলাম চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করছে। বুঝতে পারলাম আমি কাঁদছি। বিছানা থেকে উঠে বসে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে রেডিও শুনতে শুনতে আবার শুয়ে পড়লাম। আস্তে আস্তে যন্ত্রণা কমে আসতে শুরু করায় একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। রেডিওতে তখন বেজে চলছে,
You may say that I'm a dreamer
But I'm not the only one
I hope someday you'll join us
And the world will live as one…….

ভৌতিক গল্পঃ রহস্যময় লোকটি

 

-স্লামালাইকুম ভাই, একটু সরবেন ওই সিটটা আমার।
তাকিয়ে দেখি কালো, রোগা মত অদ্ভূত দর্শনের একজন লোক আমার পাশের সিট টাকে ইঙ্গিত করে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি সালামের জবাব দিয়ে সরে তাকে ভেতরে ঢোকার জন্য জায়গা করে দিলাম। ঢোকার সময় লোকটার গায়ে হাত লাগার পর তার শরীরটা কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগল। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। লোকটা মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারল এবং রহস্যময় মুচকি একটা হাসি দিল। আমি কিছুক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে অন্য পাশে ফিরে বসলাম। বাসটা ছেড়ে দিল।

অনেকদিন পর নানার বাড়িতে যাচ্ছি। বিভিন্ন সমস্যার কারনে মাঝখানে কয়েক বছর যাওয়া হয় নি। এবার একটা বড় ধরনের ছুটি পাওয়ার ফলে রওনা দিলাম। বাড়িতে নানা-নানী আর দূর সম্পর্কের দুইজন মামাতো ভাই ছাড়া কেউ থাকে না। আগে অনেক লোকজন থাকত। আমরাও বিভিন্ন সময় সেখানে চলে যেতাম। সেইসব স্মৃতি মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়। কত মজাই না করতাম।

-ভাই কি নানার বাড়ি যাচ্ছেন?
হঠাৎ লোকটা প্রশ্ন করে বসল। কিছুটা অবাক হয়ে জবাব দিলাম,
-জি, আপনি কি করে বুঝলেন?
-না আপনাকে ওই বাড়িতে দুই একবার দেখছি বলে মনে হচ্ছে। আপনার নানার নাম করিম উদ্দিন ভূঁইয়া না?
-জি, আপনি আমার নানাকে চেনেন?
-আগে প্রায় সময় ওই বাড়িতে যেতাম, এখন আর যাওয়া হয় না।
মনে মনে ভাবলাম বাড়িতে তখন অনেক লোকই আসত, সবাইকে তো আর চেনা সম্ভব না। ওদের মধ্যে কেউ একজন হবে আর কি। এমন সময় বিভিন্ন দিক থেকে হর্ণের শব্দ কানে আসতে শুরু করল। তাকিয়ে দেখি সামনে বিশাল জ্যাম লেগে গিয়েছে। আজকে মনে হয় বাড়ি যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে।
-আপনার নাম কি?
-আমার নাম সগির। আপনার নানাদের পাশের গ্রামে থাকতাম।
-থাকতাম মানে, এখন আর থাকেন না?
-নাহ।
বলে লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হুট করে একটা কথা জিজ্ঞেস করে বসল,
-আপনি কি জিন-ভূতে বিশ্বাস করেন?
হঠাৎ এই ধরনের প্রশ্ন করায় একটু অবাক হলাম।
-না, কিন্তু হঠাৎ এইগুলা জিজ্ঞেস করতেছেন কেন?
-ও আপনি মনে হয় আপনার নানার বাড়ির সামনের বাঁশঝাড় টার কথা শোনেন নাই।
-না, ওই বাঁশঝাড়ের আবার কি হইল?
কিছুটা অবাক হলাম।
-আছে, ওইটা সম্পর্কে বিরাট এক কাহিনী আছে। ওই কাহিনী শুনলে জিন-ভূতে বিশ্বাস করা শুরু করবেন।
মনে মনে ভাবলাম, প্রত্যেক গ্রামেই এ ধরনের কিছু কাহিনী প্রচলিত থাকে। এগুলো বিশ্বাস করার কোন মানে হয় না।
-আপনার যদি সমস্যা না থাকে তাহলে বলতে পারেন।
-আচ্ছা বলি তাহলে, এই কাহিনীটা ঘটছিল আমার নিজের জীবনে।
এরপর লোকটা তার কাহিনী বলা শুরু করল,

আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে ১৬ বছর বয়সী একজন যুবতী মেয়ে থাকত। বাড়িতে তার সাথে তার বাবা মা আর ছোট একটা ভাই থাকত। মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। যার ফলে প্রায় সময় গ্রামের বখাটে ছেলেরা তাকে বিরক্ত করত। একবার অন্য গ্রাম থেকে আসা এক ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব করে। কিন্তু মেয়েটা তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়, যার ফলে ছেলেটা তাকে স্কুলে যাওয়ার পথে এবং বিভিন্ন সময় দেখা হলেই বিরক্ত করত।

একবার ওই ছেলেটা দলবল নিয়ে গ্রামে এসে মেয়েটাকে রাস্তা থেকে ধরে ওই বাঁশঝাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে তারা মেয়েটাকে ধর্ষণ করে। এরপর তারা মেয়েটাকে মেরে ফেলে এবং সেখানেই ফেলে রেখে চলে যায়। পরদিন ওই জায়গা থেকে মেয়েটার লাশ উদ্ধার করা হয়, এবং ঈমাম সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী জানাজা ছাড়াই কবর দেওয়া হয়। এর আগে পুলিশের লোকজন এসে দেখে যায়, কিন্তু তারা কিছুই করতে পারে না। এই ঘটনার পর মেয়েটার পরিবার ওদের ঘরবাড়ি ফেলে অন্য কোথাও চলে যায়।

লোকটা একবারও না থেমে বলে যেতে থাকে,

তখন থেকেই গ্রামের লোকজন বলাবলি করতে থাকে ওই বাঁশঝাড়ে নাকি প্রায় সময় একটা মেয়েকে একা বসে কাঁদতে দেখা যায় এবং যুবক ছেলে দেখলেই ধরে নিয়ে যায়। তাই লোকজন রাতের বেলা ওই রাস্তাটা খুব একটা বেশি দরকার না হলে ব্যবহার করত না। আমার বয়স তখন খুব একটা বেশি ছিল না, তাই সবাই আমাকে ওই জায়গা দিয়ে চলতে নিষেধ করত। কিন্তু আমি এসব বিষয়কে খুব একটা পাত্তা দিতাম না। এগুলোকে গুজব বলেই মনে করতাম। তারপরও ওই জায়গা দিয়ে খুব একটা যেতাম না।

এক রাতের ঘটনা, এখনো পুরোপুরি মনে আছে। সেরাতে আমি বাজার করে বাড়ি ফিরছিলাম। ফেরার সময় ভাবলাম আপনার নানার বাড়ি থেকে ঘুরে যাই। তখন ওই রাস্তাটা দিয়ে রওনা দিলাম। যদিও ভূত-পেত্নিতে খুব একটা বিশ্বাস করতাম না, তারপরও ওইদিন একটু ভয় ভয় করছিল। আকাশে চাঁদের আলো ছিল বলে টর্চ টা জ্বালানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। চলার পথেই একটা কুকুর দেখতে পেলাম। কুকুরটাকে দেখেই মনে মনে একটু শান্তি পেলাম, যাক আমি ছাড়াও একটা জীবিত প্রাণী আছে। কুকুর টাও কি ভেবে আমার পিছু পিছু আসতে শুরু করল। তখন কিছুই বুঝি নাই, ভাবছিলাম কুকুরটা আমার বাজার করা জিনিসগুলোর লোভেই পিছু পিছু আসছে। আর কুকুরটা সাথে আছে বলে সাহসটাও একটু বেড়ে গিয়েছিল, তাই আর পাত্তা দেই নাই। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন বাঁশঝাড় টার কাছে আসলাম তখন হঠাৎ করে কার যেন হাসির শব্দ কানে বাজল।

এইবার একটু আগ্রহ বোধ করলাম। একটু ভয় ভয়ও লাগতে শুরু করল। ওই রাস্তা দিয়েই তো আমাকে বাড়ি যেতে হবে। লোকটা না থেমে বলে যেতে লাগল,

এই জায়গায় এত রাতে কে হাসাহাসি করতে যাবে? ভাবতেই বুকটা একটু কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই দেখি বাঁশঝাড় টার তলায় একটা মেয়ে বসে কান্না করছে। সাথে সাথে ভয়ে পুরোপুরি জমে গেলাম। তখন খেয়াল হল তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু কিছুতেই পা নাড়াতে পারছিলাম না, মনে হল কেউ যেন আটকে রেখেছে। কুকুরটা তখনো আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। একটু পর লক্ষ্য করলাম মেয়েটা উঠে দাঁড়াল, এবং হাতের ইশারা দিয়ে আমাকে ডাকতে শুরু করল। অদ্ভূত একটা আকর্ষণ অনুভব করলাম নিজের ভেতর। এবং সম্মোহিতের মত তার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার আগমন দেখে মেয়েটা হাঁটা শুরু করল, আমিও একইভাবে তার পিছু হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে কতদূর পর্যন্ত গিয়েছি খেয়াল ছিল না। আসলে কোন দিকেই খেয়াল ছিল না। মনে হচ্ছিল আমাকে সম্মোহন করে রাখা হয়েছে। একসময় একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে মেয়েটা থামল। এরপর আমাকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটু একটু করে আগানোর চেষ্টা করলাম। এমন সময় দেখলাম একটা কুকুর কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে মেয়েটার উপর ঝাপিয়ে পড়ল, সেই কুকুরটা যেটা আমার পিছু নিয়েছিল। শুরু হয়ে গেল মেয়েটা আর কুকুরটার মাঝে লড়াই। কুকুরটা মেয়েটাকে আঁচড়ে-কামড়ে ছিড়ে ফেলতে চাইছে, মেয়েটাও সমান তালে কুকুরটাকে আঘাত করছে। ততক্ষণে কিছুটা চেতনা ফিরে আসতে শুরু করল। লড়াইটা এক সময় খুব ভয়ংকর হয়ে গেলে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। তখন জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়লাম।

একবার ভাবলাম লোকটা হয়ত বানানো গল্প বলছে, কিন্তু লোকটার চেহারা দেখে ভাবনাটা বাতিল করে দিতে হল। তখনও বলে চলছে।

এরপর আর কিছুই মনে নেই। পরে সকাল হলে যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখলাম অনেকগুলো মুখ আমার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু প্রচন্ড দুর্বলতার কারনে উঠতে পারলাম না। কি হয়েছে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। পরক্ষণেই গত রাতের কথা মনে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারলাম।

আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে লোকটা একমনে বলে যেতে লাগল,

এরপর একটু সুস্থ হওয়ার পর বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে শুনলাম, তিনদিন নাকি আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে লোকজন লাগিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওই মেয়েটার পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে পাওয়া যায়। এর একদিন পর সকালে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আর আমি ভাবছিলাম মাত্র একরাত ঘুমিয়েছি। এরপর থেকেই আমার মধ্যে কিছু রহস্যময় আচরণ শুরু হয়।

-কি ধরনের রহস্যময় আচরণ?
এবার সুযোগ পেয়ে লোকটাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। লোকটা কোন জবাব না দিয়ে রহস্যময় একটা হাসি উপহার দিল। বুঝতে পারলাম লোকটা এ বিষয় নিয়ে আর কিছু বলতে চায় না। এরপর লোকটার সাথে পুরো রাস্তায় আর কথা হয় নি। আমি বিষয়টার ব্যাখ্যা কি হতে পারে তা নিয়ে অনেক্ষণ চিন্তা করতে লাগলাম। কিন্তু চিন্তা করেও কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলাম না। শেষে ভাবলাম পৃথিবীতে কত রহস্যময় ব্যাপার ঘটে থাকে সব কিছুর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব না।

বাসটা যখন পৌঁছাল তখন রাত ১০ টা বেজে গিয়েছে। রাস্তায় জ্যামের কারনে বেশি দেরি হয়ে গেছে। এত রাতে একা যেতে হবে ভেবে একটু ভয় ভয় লাগল। তখন লোকটাকে বললাম একসাথে চলেন। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। একটু খটকা লাগলেও দুজন মিলে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে খুব একটা কথা হয় নি। একসময় ওনার গল্পের সেই রাস্তার ধারে চলে আসলাম, পাশে লোকটা থাকা সত্ত্বেও ভয়টা একটু বাড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর যখন বাঁশঝাড় টার কাছে আসলাম তখন হঠাৎ দেখলাম খুব সুন্দর চেহারার একজন মেয়ে একটা কুপি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কুপির কম্পমান শিখা টার কারনে মেয়েটার চেহারাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রচন্ড ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই পাশে তাকিয়ে দেখি আমার সাথের লোকটা নেই। আবার বাঁশঝাড় টার দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটাও হাওয়া হয়ে গেছে। ভয়ে আতঙ্কে আমার অবস্থা তখন দিশেহারা। তাড়াতাড়ি করে কোনমতে পা চালিয়ে বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বারবার মেয়েটির সুন্দর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।

পরে নানাকে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারলাম সগির নামের সেই লোকটিই নাকি মেয়েটাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছিল। একদিন ওই পথে যাওয়ার সময় সে রহস্যজনক ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। এবং সে যে কাহিনী শোনাল তার অধিকাংশই নাকি মিথ্যা ছিল। এই কথা শোনার পর বড়সড় একটা ঢোঁক গিললাম। সেইদিন কি তাহলে একটা ভূতের সাথে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি? ভাবতেই কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হল।

অনেক চিন্তা করেও এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। পৃথিবীতে কতই না রহস্যময় ব্যাপার ঘটে থাকে।

(কাল্পনিক)
ছবিঃ ইন্টারনেট। 

গল্পঃ বিচ্ছেদ

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ল জাহানারা। আকাশে এখনো সূর্যটা উঠি উঠি করছে। একটু পরেই চারদিক ফর্সা হয়ে উঠবে। জাহানারা ওজু করে ফজরের নামাজ পড়তে বসল। ছেলে যাতে সুস্থ শরীর নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারে সে জন্য স্রষ্টার নিকট বেশ কিছুটা সময় নিয়ে প্রার্থনা করল।

এখনো জাহানারার অনেক গুলো কাজ বাকি পড়ে আছে। নামাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি কাজে হাত দিল। আজ তার ছেলে নীরব, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ঢাকায় চলে যাচ্ছে। এতদিন যে ছেলেটাকে সামান্য সময়ের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেয় নি, আজ তাকে অনেক দূরে চলে যেতে দিতে হচ্ছে। ভাবতেই ছলছল করে উঠল জাহানারার চোখ দুটো।

তাড়াতাড়ি করে ফ্রিজ থেকে অর্ধেক রান্না করা ইলিশ মাছটা বের করে নিল। নীরব ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করে। গতকাল বিকেলে জাহানারা নিজ হাতে বাজার থেকে ইলিশ মাছটা নিয়ে এসেছে। মাছটা যাতে তাজা থাকে তাই রাতেই অর্ধেক রান্না করে রেখেছিল। সবকিছু ঠিক করে মাছটা রান্না করা শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে আগুনের উত্তাপে পাতিলের গায়ে লেগে থাকা ঝোলগুলো শব্দ করে ছোটাছুটি শুরু করল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাহানারা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। অতীতের স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হল এইতো সেদিন ঘর আলো করে ফুটফুটে ছেলেটার জন্ম হয়েছিল। প্রথম সন্তান ছেলে হওয়াতে বাড়ির সবাই তখন ভীষন খুশি। মিষ্টি নিয়ে ছোটাছুটি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাহানারার সেদিকে খেয়াল ছিল না। সে তখন প্রসবের যন্ত্রণা ভুলে ঘুমন্ত ছেলেটার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। একটু আগে এই ছেলেটার জন্ম দিয়েছে সে, এটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না।

আস্তে আস্তে সেদিনের ছোট্ট ছেলেটা বড় হতে লাগল। দুষ্টামি আর বাঁদরামি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখত। জাহানারা নিজে পছন্দ করে তার নাম নীরব রেখেছিল। নীরব নামটা কেন জানি তার খুব পছন্দের ছিল। তখন স্বপ্ন দেখত ছেলেটাকে ডাক্তার বানাবে। আজ অবশ্য ছেলেটা ডাক্তারি পড়ার দিকে না গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাচ্ছে। এ নিয়ে জাহানারা প্রথমে একটু কষ্ট পেলেও এখন কোন আক্ষেপ নেই। এখন তার ভাবনা, ছেলের জন্য ডাক্তার দেখে একটা মেয়ে ঘরে নিয়ে আসবে। ভাবতেই ঘোমটা পড়া লাজুক টাইপের একটা মেয়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে মনে কিছুটা আনন্দ পেল।

আস্তে আস্তে মাছটা হয়ে আসছে। জাহানারা অন্য চুলায় ভাত চড়িয়ে দিল। ঘড়িতে দেখল সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি গেল নীরবকে জাগাতে। সাড়ে সাতটায় ট্রেন, এখন না উঠলে রেডি হতে দেরি হয়ে যাবে।
-নীরব, এই নীরব তাড়াতাড়ি ওঠ বাবা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নীরব একটু নড়ে চড়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
-নীরব, ওঠ বলছি। ট্রেন মিস হয়ে যাবে কিন্তু।
ঘুম জড়িত কণ্ঠে নীরব জবাব দিল,
-কয়টা বাজে আম্মু?
-সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে।
-আরেকটু ঘুমাই আম্মু? সব তো রেডি করাই আছে।
জাহানারার হঠাৎ করে ছেলেটার জন্য খুব মায়া লাগল। কত আরাম করে ঘুমাচ্ছে। থাক না আর একটু ঘুমিয়ে।
একসময় স্কুলে পাঠানোর জন্য ছেলেটাকে এভাবে জাগাতে হত। হঠাৎ পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। ভীষন জালাতন করত ছেলেটা। ওর বাবা এ নিয়ে সব সময় বকাবকি করত, কিন্তু জাহানারা সব সময় ওকে আদর করে জাগাত। এখন আর তাকে এভাবে জাগাতে হবে না। সব সময় নিজে থেকেই উঠতে হবে। ভাবতেই দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে এল। জাহানারা ঠিক করল, সরাসরি জাগাতে না পারলেও মোবাইলে কল দিয়ে ঠিকই প্রতিদিন জাগিয়ে দেবে।
-ঠিক আছে, কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে উঠে পড়বি।

কথাটা বলে জাহানারা আবার রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। মাছটা থেকে খুব সুন্দর গন্ধ বের হতে শুরু করেছে। জাহানারা মনে মনে খুশি হয়ে উঠল, যাক মসলাপাতি সব ঠিকঠাক আছে তাহলে। ভাত টাও আস্তে আস্তে ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। মাছটা নামিয়ে আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ বেজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে আবার গেল নীরবকে জাগাতে।
-এই নীরব উঠে পড়, আর জাগাতে পারব না কিন্তু। শেষে ট্রেন মিস করলে আমাকে দোষ দিতে পারবি না।
শেষ পর্যন্ত কাজ হল। নীরব আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসল।
-উফ আম্মু, তুমি খুব বিরক্ত কর। তোমার জন্য শান্তি মত একটু ঘুমাতে পারি না।
বলেই বিরক্তি নিয়ে একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল, আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে ছুটল। জাহানারা ছেলের চলে যাওয়া দেখে মনে মনে বলল, আর তোকে এভাবে বিরক্ত করতে পারব না। আবার দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে এল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার রান্নাঘরের দিকে ছুটল জাহানারা। ভাতটা মনে হয় হয়ে এসেছে।

আস্তে আস্তে ভাতটা পরীক্ষা করে পাতিলটা নামিয়ে মাড়টা ফেলে দিল। নীরবও হাতমুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়েছে। জাহানারার সাথে মুখোমুখি হতেই মিষ্টি একটা হাসি দিল। জবাবে জাহানারা ও হাসি দিল।
-তাড়াতাড়ি খেতে আয়, টেবিলে ভাত দিয়ে দিচ্ছি।
-আসছি আম্মু, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।

নীরব গেল তার ব্যাগটা শেষবারের মত গুছিয়ে নিতে। ভাল মত চারদিকে দেখল, কোন জিনিস ফেলে যাচ্ছে কিনা। টাওয়েল টার কথা মনে হতেই ব্যাগে দেখল সেটি নেই।
-আম্মু, আমার টাওয়েলটা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না।
-দাঁড়া দেখছি। মনে হয় বারান্দায় আছে। এনে দিচ্ছি।

বারান্দায় গিয়ে দেখল টাওয়েলটা এখনো শুকায় নি। ভেজা টাওয়েলটা নিয়েই নীরবের রুমে চলে আসল।
-এই নে, এখনো ভাল মত শুকায় নাই। পলিথিনে ভরে নিয়ে নে।
-আর শোন, গিয়েই শুকাতে দিয়ে দিবি।
-ঠিক আছে আম্মু।

সব কিছু গুছিয়ে নীরব ভাত খাওয়ার টেবিলে চলে আসল। টেবিলে ইলিশ মাছ দেখে খুব খুশি হয়ে উঠল।
-ওয়াও! ইলিশ মাছ। থ্যাঙ্কু আম্মু।

জাহানারা মনে মনে খুশি হয়ে উঠে, তার কষ্ট সার্থক হয়েছে। মুখে হাসি নিয়ে ছেলের দিকে তাকাল।
-তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।

নীরব খাওয়া শুরু করলে জাহানারা তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। ছেলেটা খুব মজা করে খাচ্ছে। কতদিন যে ওকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারব না। জাহানারা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সেদিনের পিচ্চি ছেলেটা আজ কত বড় হয়ে গেছে। একসাথে দুইটা মাছ দিতে হত তাকে, না হলে খেতেই বসত না।
-মাছ আরেক টুকরা দেই?
-না আম্মু। যে পরিমাণ কাঁটা আছে, তাতে আরেকটা খেতে গেলে আর ট্রেন ধরতে হবে না।

জাহানারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সময় প্রায় হয়ে এসেছে, তাই আর জোর করল না। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

নীরব ঘড়িতে দেখল সাড়ে ছয়টা বেজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে লাগল। ওদিকে জাহানারা রেডি হওয়ার জন্য চলে গেল।

খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নীরব জাহানারার রুমে চলে আসল। জাহানারা ও রেডি হয়ে নিল।
-আম্মু, তোমার কষ্ট করে যাওয়ার কি দরকার ছিল? আমি একাই তো চলে যেতে পারতাম।
-আরে কোন সমস্যা না, আজকেই তো খালি দিয়ে আসব। তোর আব্বুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নে।

নীরব তার আব্বুর কাছে গিয়ে সালাম করল।
-আব্বু, আমি যাচ্ছি।
-ঠিক আছে, ভাল মত থাকিস। আর গিয়ে একটা ফোন করিস।
-ঠিক আছে আব্বু।
-আমি তোর সাথে যাচ্ছি না, তোর আম্মু যাবে।
-ঠিক আছে, কিন্তু কোন দরকার ছিল না।

আব্বুর সাথে আর কথা না বাড়িয়ে নীরব চলে গেল তার ছোট বোন সুমির রুমে। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে, জাহানারার সাথে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে দুইজন উঠে বসল। ট্যাক্সিতে বসার পর হঠাৎ জাহানারার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার নীরবের খুব জ্বর হয়েছিল। খুব ভয়ানক অবস্থা, বাসায় নীরবের আব্বু ও নেই। জাহানারা বাধ্য হয়ে নিজেই ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে রওনা দিয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে দেখল একটা ট্যাক্সিও নেই। শেষে অনেক্ষণ নীরবকে কোলে নিয়ে হাঁটার পর একটা ট্যাক্সি পেয়েছিল। তখন কত ছোটই না ছিল ছেলেটা। একা কিছুই করতে পারত না। আর আজ কোথায় চলে যাচ্ছে। অসুখ হলে তাকে কে দেখবে? দৃষ্টিটা আবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। না চোখটা আজকে খুব জ্বালাচ্ছে। জাহানারা চোখের উপর কপট রাগ দেখাল।
-ঠিক মত থাকবি, ভাল মত খাওয়া দাওয়া করবি। আর অসুখ যাতে না করে সেই চেষ্টা করবি।
-আম্মু, তুমি এত টেনশন করতেছ কেন? আমি এখনো ছোট আছি নাকি?
-থাক আর পাকামো করতে হবে না। অসুখ হলে তো শুয়ে শুয়ে কাঁদবি, তখন কে তোকে দেখতে আসবে?
-অসুখ হলে সাথে সাথে তোমাকে ফোন করে দিব, তুমি চলে এস।

ট্যাক্সি টা স্টেশনে এসে পৌঁছালে জাহানারা নীরবকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বাহিরে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। নীরব জানালার পাশে বসেছে বলে বাহিরে থেকে জাহানারা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলের সামনে কোনরকম কান্নাকাটি করবে না, আগেই ঠিক করে নিয়েছিল। কিন্তু ধরে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নীরবের অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করল জাহানারা। ছেলেটা অনেক স্বাভাবিক আছে। কিন্তু ভিতরে যে কষ্ট হচ্ছে সেটা কেউ না বলে দিলেও জাহানারা বুঝতে পারছে। মা ছেলে নির্বাক ভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় শব্দ করে ট্রেন ছেড়ে দিল। জাহানারা শেষবারের মত হাত বাড়িয়ে ছেলেকে আদর করার চেষ্টা করল। ট্রেনটা ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল। জাহানারা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ঝাপসা দৃষ্টিতে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে রইল। নীরবও জানালা দিয়ে মাথা বের করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটোও ছল ছল করছে। ট্রেনটা একসময় একটা বিন্দুর মত দূরে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর সম্বিত ফিরে পেল জাহানারা।

তখন সুমির কথা মনে পড়ল। মেয়েটাকে তো স্কুলে পাঠাতে হবে। সুমির কথা মনে পড়ায় চিন্তা করল এখন তো সুমি আছে, কিন্তু একসময় সুমিকে ও এভাবে বিদায় জানাতে হবে। তখন সে একা একা কি করবে। এই সন্তান দুটিই ছিল তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। এরা দুজনই যদি দূরে চলে যায়, তাহলে কি নিয়ে বেঁচে থাকবে? কাঙ্খিত বিচ্ছেদেও এত যন্ত্রণা কেন? বাস্তবতা এত কঠিন হয় কেন? এই প্রশ্নগুলো জাহানারা নিজেকেই করল। কিন্তু সে তো এগুলোর উত্তর জানে না। কখনো জানতেও পারবে না। ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে স্টেশন থেকে বের হতে লাগল।